ভূমিকম্প কেন হয়?
কখনও কি ভেবে দেখেছেন ভূমিকম্প
কেন হয়? কেন বিশেষ বিশেষ কিছু
স্থানে ভূমিকম্প বেশী হয় আবার কিছু
স্থানে মোটামোটি ভূমিকম্প হয় না
বললেই চলে? এ প্রশ্নগুলো বহু শত বছর ধরে
মানুষকে ভাবালেও এর উত্তর পেতে
অপেক্ষা করতে হয়েছে বিংশ শতাব্দী
পর্যন্ত। ১৯১২ সনে জার্মান বিজ্ঞানী
আলফ্রের্ড ওয়েগনার পৃথিবীর মানচিত্র
পর্যবেক্ষণ করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত
হন যে এক সময় পৃথিবীর মহাদেশগুলো
একত্রে ছিল যা কালক্রমে ধীরেধীরে
একে অপরের থেকে দূরে সরে
গিয়েছে। ওয়েগনারের এই তত্ত্বকে
বলা হয় কন্টিনেন্টাল ড্রিফ্ট। এ তত্ত্ব
বলে পৃথিবীর উপরিতল কতগুলো অনমনীয়
প্লেটের সমন্বয়ে গঠিত। এই
প্লেটগুলোকে বলা হয় টেকটনিক প্লেট।
একেকটি টেকটনিক প্লেট মূলতঃ
পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ গলিত পদার্থের
বাহিরের আবরণ যা একটি পাথরের স্তর।
ভূ-স্তরে যা কিছু রয়েছে তা এই
প্লেটগুলোর উপরে অবস্থিত।
টেকটনিক প্লেটগুলো একে অপরের
সাথে পাশাপাশি লেগে রয়েছে।
এগুলো প্রায়ই নিজেদের মাঝে
ধাক্কায় জড়িয়ে পড়ে। কখনও মৃদু, কখনও
সজোরে। যেহেতু প্লেটগুলো শিলা
দ্বারা গঠিত, তাই ধাক্কার ফলে
তাদের মাঝে ঘর্ষণের সৃষ্টি হয়। এই
ঘর্ষণের মাত্রা অধিক হলে এক ধরনের
শক্তি নির্গত হয় যা ভূ-স্তরকে প্রকম্পিত
করে। যদিও ভূমিকম্পের আরও কারণ
রয়েছে (যেমন আগ্নেয়গিরি), তবে এই
কারণটিই অধিকাংশ ভূমিকম্পের জন্যে
দায়ী।
উপরের আলোচনা থেকে একটা বিষয়
সম্পর্কে অনেকেই হয়তো ধারণা করে
নিয়েছেন। তা হলো ভূমিকম্প বেশী
হবার সম্ভাবনা থাকবে প্লেট বর্ডারে।
হ্যা, আসলেই তাই। যেখানেই দুটো
প্লেটের সংযোগস্থল রয়েছে
সেখানেই ঘর্ষণ সৃষ্টি হবার সম্ভাবনা
থাকবে এবং এর ফল স্বরূপ হবে ভূমিকম্প।
নিচের ছবিটি দেখুন। এই ছবিতে
টেকটনিক প্লেটগুলো এবং সেগুলোর
নাড়াচাড়ার গতি পথ দেখানো
হয়েছে। জাপান, চিলি, হেইতি বা
ইন্দোনেশিয়ার দিকে যদি তাকান
তাহলে পরিষ্কার বুঝতে পারবেন কেন
ঐ স্থানগুলোতে নিয়মিত বড় বড় ভূমিকম্প
হয়ে থাকে।
বাংলাদেশের ভূমিকম্প প্রবণ এলাকা
সমূহ কী করে চিহ্নিত করা হলো?
এবার ফিরে আসা যাক বাংলাদেশ
প্রসঙ্গে। দুর্ভাগ্যবশতঃ আমাদের
বাংলাদেশ ভারতীয়, ইউরেশিয় এবং
মায়ানমার টেকটনিক প্লেটের মাঝে
আবদ্ধ। ফলে এই প্লেটগুলোর
নাড়াচাড়ার ফলে আমাদের দেশে
মাঝেমাঝেই ভূমিকম্প অনুভূত হয়।
তাছাড়া ভারতীয় এবং ইউরেশিয়
প্লেট দুটো হিমালয়ের পাদদেশে
আটকা পড়ে রয়েছে এবং ১৯৩৪ সনের পর
তেমন কোন বড় ধরনের নাড়াচাড়া
প্রদর্শন করে নি। এ কারণে
বিজ্ঞানীরা ধারণা করছে এই প্লেট
দুটো হয়তো নিকট ভবিষ্যতে নড়ে উঠবে
যা বড় ধরনের ভূমিকম্পের কারণ হবে।
টেকটনিক প্লেটের অবস্থান দেখলে
বোঝা যায় যে আমাদের উত্তর ও পূর্বে
দুটো বর্ডার বা টেকনিকাল ভাষায় “ভূ-
চ্যুতি” রয়েছে যা বাংলাদেশের
ভূমিকম্পের কারণ। এজন্যে
বাংলাদেশের উত্তরপূর্বাঞ্চল তথা
সিলেট এবং ততসংলগ্ন এলাকা প্রবল
ভূমিকম্প প্রবণ। এর পরের অংশগুলোও যেমন
ঢাকা ও রাজশাহী শহরও ভূমিকম্প প্রবণ
এলাকা। নিচের ছবিতে
বাংলাদেশের মানচিত্রে লাল অংশ
বেশী, হলুদ মাঝারি এবং সবুজ অংশ কম
ভূমিকম্প প্রবণ এলাকা হিসেবে
চিহ্নিত করা হয়েছে।
১৮৯৭ সনের ১২ জুন ৮.৭ মাত্রার “দ্যা
গ্রেট ইন্ডিয়ান আর্থকোয়েক”
ভারতবর্ষকে আঘাত হানে যা আজও
পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ ভূমিকম্প হিসেবে
পরিচিত। এই ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল ছিল
ভারতের শিলং শহর তবে এর প্রভাব
বর্তমান বাংলাদেশ সহ বহু দূর পর্যন্ত
অনুভূতি হয়েছিল। সে সময়ের ঢাকায়
অবস্থিত বিভিন্ন মিশনারীদের
বিল্ডিং ভেঙ্গে পড়েছিল এই
ভূমিকম্পের কারণে। এছাড়াও ঢাকায়
৪৫০ জনের মত নিহত হবার খবর পাওয়া
গিয়েছিল যা সেই সময়ের তুলনায়
রীতিমত অনেক বড় সংখ্যা।
এ ভূমিকম্পগুলোর একটা বৈশিষ্ট্য সবার
দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। মোটামোটি
প্রতি একশ বছর পরপর এই অঞ্চলে বড় ধরনের
ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে। ১৯১৮ সন ছিল
সর্বশেষ বড় ভূমিকম্পের বছর। এরপর প্রায়
একশ বছর কেটে গিয়েছে কিন্তু আর
কোন বড় ভূমিকম্প আঘাত করে নি
বাংলাদেশকে যা বিজ্ঞানীদের
ভাবিয়ে তুলেছে। অনেক
আবহাওয়াবিদ এটাও মনে করেন যে
ছোটছোট ভূমিকম্প বড় ভূমিকম্পের
বার্তা বহন করে। সে হিসেবে
বাংলাদেশে বড় ধরনের ভূমিকম্প যে
কোন সময় আঘাত হানতে পারে। আর
যদি সেটা ঘটে, তাহলে সেটার
ভয়াবহতা হবে মারাত্মক।
ভূমিকম্পের সময় কী করা উচিত?
ভূমিকম্পের সময় শক্তিশালী টেবিল বা
এ ধনের আসবাবের নিচে আশ্রয় গ্রহণ
করা উচিত। কোন অবস্থাতেই কাঁচের
জানালার পাশে অথবা এমন দেয়াল
যা পড়ে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে,
তার পাশে অবস্থান নেয়া যাবে না।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, যদি ভূমিকম্পের
সময় আপনি বিছানায় থাকেন, তাহলে
সেখানেই থাকুন এবং বালিশ দিয়ে
নিজেকে ঢেকে রাখুন। তবে লক্ষ্য
রাখবেন ঝাড়বাতি বা ফ্যান জাতীয়
কিছু ঘরে থাকলে সেটা থেকে
নিরাপদ দূরত্বে থাকুন। আশেপাশে শক্ত
পিলার থাকলে সেটার নিচে আশ্রয়
নিন। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা
গিয়েছে ভূমিকম্পের সময় অধিকাংশ
মানুষ আহত অথবা নিহত হন ভূমিকম্প
চলাকালিন অবস্থান পরিবর্তেনের সময়।
তাই কোন অবস্থাতেই ভূমিকম্প হওয়ার
সময় দৌড় দেয়া অথবা দ্রুত বিল্ডিং
থেকে নেমে যাওয়ার চেষ্টা করবেন
না। উঁচু দালানের টপ ফ্লোরে থাকলে
ছাদে চলে যাওয়া নিরাপদ কিন্তু যদি
দরজা বা রাস্তা পরিষ্কার জানা না
থাকে তাহলে ঘরেই অবস্থান নেয়া
উচিত। আপনি যদি বাহিরে থাকেন
এবং ভূমিকম্প হয়, তাহলে বিল্ডিং
থেকে দূরে থাকুন। ১৯৩৩ সনে
যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের “লং বিচ
আর্থকোয়েক”-এ অধিকাংশ মানুষ মারা
গিয়েছিল যারা বিল্ডিং-এর
বাহিরে ছিল। সে সময় বিভিন্ন
স্থানে দেয়াল ধসে তাদের মৃত্যু
হয়েছিল। এছাড়া আপনি যদি ড্রাইভ
করতে থাকেন এবং ভূমিকম্প অনুভব করেন,
তাহলে গাছ, বিল্ডিং, বৈদুতিক খুঁটি
ইত্যাদি থেকে দূরে নিরাপদ স্থানে
গাড়ি পার্ক করে থেমে থাকা
বুদ্ধিমানের কাজ।
রেফারেন্স এবং কৃতজ্ঞতা স্বীক
ভূমিকম্প কেন হয়?
25 Saturday Apr 2015
Posted Others
in