২০০৩ সালের ৭ এপ্রিল মহামান্য উচ্চআদালতের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতিমো: হামিদুল হক ও বিচারপতি সালমা মাসুদচৌধুরী ‘ব্লাস্ট বনাম বাংলাদেশ সরকার’মামলায় এবং ২০০৩ সালের ৪ আগস্ট তৎকালীনহাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি এসকেসিনহা (বর্তমানে আপিল বিভাগেরবিচারপতি) ও বিচারপতি শরিফউদ্দীনচাকলাদার‘ সাইফুজ্জামান বনাম বাংলাদেশসরকার’ মামলায় ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪এবং ১৬৭ ধারায় কোনো ব্যক্তিকে‘গ্রেপ্তার করা ও রিমান্ডে নেয়ার’ বিষয়েবেশকিছু নির্দেশনা‘ বাস্তবায়ন ও প্রয়োগের’নির্দেশ দিয়েছিলেন। যা আজও যুগান্তকারীও অত্যাধুনিক নির্দেশনা হিসাবেই আইনপাড়ায় সমাদৃত।তবে দুঃখের বিষয় হলো, আজ পর্যন্ত মাননীয়বিচারপতিদের সেই রায়টি সম্পর্কে সাধারণমানুষ জানে না এবং আইনের সাথেসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মহামান্য উচ্চ আদালতেরসেই যুগান্তকারী রায়টি সঠিকভাবে পালনকরছেন না। রায়টি জনস্বার্থে উল্লেখ করাহলো -এই নির্দেশনাগুলোর আলোকে পুলিশ ওম্যাজিস্ট্রেটদের অবশ্যপালনীয়কর্তব্যগুলো নিম্মরূপ:০১। ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনেআটকাদেশ (ডিটেনশন) দেবার জন্য পুলিশকোনো ব্যক্তিকেই ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তারকরতে পারবেন না।০২। কোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের আগেসংশ্লিষ্ট পুলিশ অফিসার তাঁর পরিচয় দেবেনএবংপ্রয়োজনে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিসহউপস্থিত অন্যরাও পরিচয়পত্র দেখাবেন।০৩। গ্রেপ্তার ব্যক্তিকে থানায় নিয়ে আসারপর সংশ্লিষ্ট পুলিশ অফিসার দ্রুতগ্রেপ্তারের কারণগুলো (অভিযোগ) লিখেরাখবেন। সেখানে থাকবে- আমলযোগ্যঅপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ততার তথ্য, অপরাধেরবিস্তারিত বিবরণ, যে পরিস্থিতিতেগ্রেপ্তার করা হয়েছে তার তথ্য, তথ্যের উৎসও তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতারকারণ এবংস্থানের বর্ণনা, সময়,গ্রেপ্তারেরসময়উপস্থিত ব্যক্তিদের নাম ঠিকানা থানারডায়েরিতে লিখে রাখতে হবে।০৪। গ্রেপ্তার ব্যক্তির শরীরে কোনোআঘাতের চিহ্ন পেলে পুলিশ তা লিখেরাখবেন এবংকাছাকাছি কোনোহাসপাতালে বা সরকারি ডাক্তারকেদেখিয়ে চিকিৎসা করে তার কাগজপত্রসংগ্রহ করবেন।০৫। গ্রেপ্তার ব্যক্তিকে থানায় আনার তিন(০৩) ঘণ্টার মধ্যে পুলিশ গ্রেপ্তারের কারণ /অভিযোগপত্র তৈরি করবেন।০৬। কোনো ব্যক্তিকে বাসস্থান বা কর্মস্থলথেকে গ্রেপ্তার করা না হলে তাকে থানায়আনার এক ঘণ্টার মধ্যে পুলিশ তার আত্মীয়-স্বজনদেরকে টেলিফোনে বা লোক মারফতগ্রেপ্তারের সংবাদ জানাবেন।০৭। পুলিশ গ্রেপ্তার ব্যক্তিকে তার পছন্দনীয়আইনজীবী বা নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে পরামর্শবা দেখা করার অনুমতি দিতে বাধ্য থাকবেন।০৮। যখন কোনো গ্রেপ্তার ব্যক্তিকে নিকটতমম্যাজিস্ট্রেটেরকাছে ২৪ ঘণ্টার মধ্যেহাজির করা হয়, তখন পুলিশ কর্মকর্তাফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৭ (১) ধারাঅনুযায়ী লিখিত বক্তব্য পেশ করবেন যে,কেন ২৪ ঘন্টার মধ্যে তদন্ত সম্পন্ন হয়নি এবংকেন তিনি মনে করেন যে, গ্রেপ্তার ব্যক্তিরবিরুদ্ধে অভিযোগ বা তথ্যগুলো যুক্তিসংগত ওসুদৃঢ় । একইসঙ্গে তিনি মামলার প্রাসঙ্গিককাগজপত্র ম্যাজিস্ট্রেটেরসামনে পেশকরবেন।০৯। যদি ম্যাজিস্ট্র্টে তদন্তকারীকর্মকর্তার পাঠানো পত্রে ও মামলারলিখিত ডায়েরির বর্ণনা পড়ে সন্তুষ্ট হন যে,গ্রেপ্তার ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগবাতথ্যগুলো যুক্তিসঙ্গত এবং তাকে জেলেরাখার যথেষ্ঠ উপকরণ মামলার ডায়েরিতেরয়েছে,তবে তিনি গ্রেপ্তার ব্যক্তিকেকারাগারে পাঠানোর নিদের্শ দেবেন।অন্যথায় তাৎক্ষণিকতাকে মুক্তি দেবেন।১০। গ্রেপ্তার ব্যক্তির বিরুদ্ধেঅভিযোগগুলো যুক্তিসঙ্গত না হওয়ায় এবংতাকে জেলে রাখার যথেষ্ট উপকরণমামলার ডায়েরিতে না থাকায় যদিম্যাজিস্ট্রেট ওই ব্যক্তিকে মুক্তি দেনতবে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯০ (১)(গ)ধারায় ওই ম্যাজিস্ট্রেট সংশ্লিষ্টপুলিশ অফিসারের বিরুদ্ধে আইনগতকার্যক্রম শুরু করবেন । একইসঙ্গে ওয়ারেন্টছাড়া ওই ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করারকারণে ওই পুলিশ অফিসার দন্ডবিধির ২২০ধারা অনুযায়ী বিদ্বেষের বশবর্তী হয়ে বাউৎকোচ নিয়ে ওই ব্যক্তিকে আটক রাখারঅভিযোগে অভিযুক্ত হবেন।১১। গ্রেপ্তার ব্যক্তিকে ম্যাজিস্ট্রেটপুনরায় জেলহাজতে পাঠানোর পরওসংশ্লিষ্ট পুলিশ অফিসার তদন্তেরপ্রয়োজনে ওই ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদকরতে পারবেন। তবে জিজ্ঞাসাবাদের জন্যনির্ধারিত কক্ষটি নিম্মরূপ লিখিতশর্তানুযায়ী হতে হবে।শর্তগুলো হলো-জিজ্ঞাসাবাদ কক্ষটির এক পাশে কাঁচেরদেয়াল ও গ্রিল থাকবে, যাতে গ্রেপ্তারব্যক্তির আত্মীয়-স্বজন বা আইনজীবীজিজ্ঞাসাবাদের দৃশ্যটি দেখতে পারেনকিন্তু শুনতে পাবেন না।গ্রেপ্তার ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্যপুলিশ হেফাজতে নেবার আবেদনপত্রেজিজ্ঞাসাবাদের বিস্তারিত যুক্তিসঙ্গতকারণ উল্লেখ করতে হবে। বিবেচনার জন্যমামলার কেস ডায়েরিটি ম্যাজিস্ট্রেটেরকাছে পেশ করতে হবে।যদি ম্যাজিস্ট্রেট তদন্তকারী কর্মকর্তারআবেদনে সন্তুষ্ট হন, তাহলে তিনি কারণগুলোলিখে নিয়ে গ্রেপ্তার ব্যক্তিকে পুলিশহেফাজতে পাঠানোর আদেশ দেবেন। তবেসেটা তিন দিনের বেশি অবশ্যই নয়।১৩। যদি ম্যাজিস্ট্র্টে গ্রেপ্তার ব্যক্তিকেপুলিশ হেফাজতে নেবার জন্য পুনরায়আদেশদেন তবে এই মর্মে নিশ্চিত হবেন যে-গ্রেপ্তারের সময় ওই ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারেরকারণ জানানো হয়েছিল, পছন্দনীয়আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শের সুযোগ দেয়াহয়েছিল, পুলিশ হেফাজতে পাঠানোর আগেম্যাজিস্ট্রেট আটক ব্যক্তির আইনজীবীরবক্তব্যও শুনবেন। ওই ম্যাজিস্ট্রেট আটকব্যক্তিকে পুনরায় পুলিশ হেফাজতেপাঠানোর এই আদেশ অনুমোদনেরজন্যসংশ্লিষ্ট জেলার দায়রা জজ/মেট্রোপলিটন দায়রা জজের কাছেপাঠাবেন।অনুমোদন পাওয়ার গেলে হেফাজতে নেয়ারআগে তদন্তকারী কর্মকর্তা অবশ্যই নির্দিষ্টসরকারি ডাক্তার বা মেডিকেল বোর্ডদ্বারা আটক ব্যক্তির ডাক্তারি পরীক্ষাসম্পন্ন করবেন এবং ডাক্তারি প্রতিবেদন ওইম্যাজিস্ট্রেটেরকাছে পেশ করবেন।যদি ম্যাজিস্ট্রেট ডাক্তার বা মেডিকেলবোর্ডের প্রতিবেদনে পুলিশ হেফাজতে আটকব্যক্তিকে নির্যাতনের বা আঘাত প্রাপ্তহওয়ার কোনো প্রমাণ পান তবে তিনিফৌজদারিকার্যবিধি ১৯০ (১) (গ) ধারায় ওইপুলিশ অফিসারের বিরুদ্ধে আইনগত কার্যক্রমশুরু করবেন। একইসঙ্গে ওই পুলিশ অফিসারদন্ডবিধির ৩৩০ ধারা অনুযায়ী, ভিত্তিহীন/অযৌক্তিক অপরাধে জড়িত থাকারস্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য আটকব্যক্তিকে নির্যাতন/পীড়ন করার অপরাধেঅভিযুক্ত হবেন। যার সর্বোচ্চ শাস্তি ৭ বছরপর্যন্ত যে কোনো মেয়াদে সশ্রম বাবিনাশ্রম কারাদন্ড। একই সঙ্গে অর্থদন্ডওহতে পারে।১৪। যদি থানা পুলিশ হেফাজত/জেলখানায়আটক ব্যক্তির মৃত্যু ঘটে তবে সংশ্লিষ্টথানার কর্মকর্তা/তদন্তকারী কর্মকর্তা/তদন্তকারী অফিসার/ জেলার এই মৃত্যুর খবরতৎক্ষণিক কাছের ম্যাজিস্ট্রেটকেজানাবেন।১৫। পুলিশ হেফাজতে বা জেলে মৃত্যুর সংবাদপাবার পর অবশ্যই ম্যাজিস্ট্রেট অতিদ্রুতঘটনাস্থলে যাবেন এবং কোন ধরনেরঅস্ত্রে বা কিভাবে শরীরে ক্ষত হয়েছে তাউল্লেখ করে মৃত্যু কিভাবে হয়েছে তারএকটি প্রতিবেদন তৈরি করবেন। একইসঙ্গেমৃত ব্যক্তির ময়নাতদন্তের ব্যবস্থা করবেন।১৬। উপর্যুক্ত নির্দেশনাগুলো যথাসময়ে ওযথাযথভাবে মেনে না চললে সংশ্লিষ্ট পুলিশঅফিসার এবং ম্যাজিস্ট্রেট আদালতঅবমাননার অপরাধে অভিযুক্ত হবেন।
উচ্চআদালতের হাইকোর্ট বিভাগ
09 Saturday May 2015
Posted LAW
in