চোরাচালান একটি বেআইনী আন্তর্জাতিক
বাণিজ্য কার্য্যক্রম। সীমান্তের আইন-
নির্দ্দিষ্ট পথ এবং শুল্কঘাঁটি এড়িয়ে পণ্য
আমদানী বা রপ্তানী করলে চোরাচালান
সংঘটিত হয়। যারা চোরাচালান করে তাদের
বলা হয় চোরাচালানকারী । অনেক সময়
চোরাচালানকে পণ্য পাচার হিসেবেও
বণর্না করা হয়। সাধারণত: শুল্ক বিভাগ
চোরাচালান প্রতিরোধে নিযুক্ত থাকে।
আইনী সংজ্ঞা
বাংলাদেশের শুল্ক আইন ১৯৬৯-এর ধারা
২(এস)-এ চোরাচালানের আইনী সংজ্ঞার্থ
বিধৃত আছে। এছাড়া বাংলাদেশের বিশেষ
ক্ষমতা আইন ১৯৭৪-এও চোরাচালান-এর আইনী
সংজ্ঞার্থ দেয়া হয়েছে শাস্তির বিধান
সংযোজিত হয়েছে। চোরাচালান এবং অবৈধ
আমদানী সমার্থক নয়। বৈধ পথে বা শুল্ক
ঘাঁটির মাধ্যমে চোরাচালান হয় না, হয় অবৈধ
আমদানী যার উদ্দেশ্য শুল্ক ফাঁকি অথবা
আমদানী-রপ্তানী আইন লঙ্ঘন এবং, ক্ষেত্রে
বিশেষে, উভয়ই। এছাড়া মুদ্রা, স্বর্ণ, পর্নো
সামগ্রী ইত্যাদির জন্য পৃথক সংজ্ঞার্থ
আছে। পাকিস্তানের আইন অনুরূপ। তবে
চোরাচালান নিয়ন্ত্রণের জন্য পাকিস্তানে
প্রিভেশান অব স্মামগলিং অ্যাক্ট ১৯৭৭
নামে পৃথক আইন আছে।
চোরাচালানের উদ্দেশ্য
চোরাচালানের উদ্দেশ্য প্রধানতঃ দুটি।
একটি হলো পণ্য আমদানী-রপ্তনীর ওপর কোন
নিষেধাজ্ঞা থা্কলে তা এড়িয়ে অবৈধ
সীমান্ত পথে পণ্য আনা-নেয়া করা।
দ্বিতীয়তঃ আমদানী-রপ্তনীর বৈধ পথ এবং
শুল্ক ঘাঁটি এড়িয়ে বাণিজ্যের অর্থাৎ
পাচারের মাধ্যমে সরকার ধার্য্য শুল্ক-কর
ফাকিঁ দেয়া।
চোরাচালানী পণ্য
চোরাচালানী পণ্যসমূহকে প্রধানত দুটি ভাগে
ভাগ করা যায়। প্রথমতঃ এমন পণ্য যার
আমাদনী বা রপ্তানী সম্পূর্ণ বা আংশিক
নিষিদ্ধ। দ্বিতীয়তঃ এমনসব পণ্যাদি যেসব
আমদানী (বা রপ্তানী) যোগ্য কিন্তু শুল্ক
ফাঁকি বা অন্যান্য উদ্দেশ্যে সেসব পাচার
করা হয়েছে।
নিষিদ্ধ পণ্য
কোন্ কোন্ পণের আমদানী বা রপ্তানী
নিষিদ্ধ তা আমদানী রপ্তানী সংক্রান্ত
আইন ও বিধিমালায় বর্ণিত আছে। এসব পণ্য
বৈধ পথেও আমদানী-রপ্তানীযোগ্য নয়। কোন
কোন পণ্যের ক্ষেত্রে এই নিষেধাজ্ঞা
আংশিক। যেমন অস্ত্র-শস্ত্র। এটি কেবল
শর্তসাপেক্ষে আমদানীযোগ্য পণ্য।
উচ্চ শুল্কের পণ্য
উচ্চ শুল্ক হার বলবৎ আছে এমন পণ্য যেমন
সিগারেট, মদ জাতীয় দ্রব্যাদি
চোরাচালানকারীদের নিকট পাচারের
আকর্ষণীয় পণ্য। শুল্ক ঘাটিঁ এড়িয়ে পণ্য আনয়ন
করা হয় বিধায় শুল্ক দিতে হয় না এবং কম
মূল্যে চোরাচালানী পণ্যটি বাজারজাত করা
যায়।
সোনা, মণিমাণিক্য
সোনা এবং মণিমাণিক্যের পাচার একটি
অবিরল ঘটনা। বিশেষ করে মধ্য প্রাচ্য থেকে
বাংলাদেশে সোনার বিস্কুট আনয়ন করা হয়।
প্রধানত বিমানযাত্রীরাই স্বর্ণ পাচারে
জড়িত। ঢাকা বিমান বন্দরে মাঝে মাঝে
স্বর্ণের বড় বড় চোরাচালান ধরা পড়ে। অনেক
নেপালী নাগরিক এই সোনা চোরাচালানে
জড়িত। আবার বিমান কর্মীরাও সংশ্লিষ্ট
থাকে এমন খবর পত্র-পত্রিকায় পাওয়া যায়।
বৈধ পথে কিংবা শুল্ক ঘাঁটির মাধ্যমে
ঘোষণা না-দিয়ে স্বর্ণ আনয়নের প্রচেষ্টাকে
অবৈধ আমদানীর পরিবর্তে চোরাচালান
হিসেবে গণ্য করা হয়। শুল্ক আইনে এমত পৃথক
প্রবিধান রয়েছে।
বাংলাদেশ ভারতে সোনা চোরাচালনের
অন্যতম রুট। বাংলাদেশে যে সব
চোরাচালানের সোনা ধরা পড়ে তার
অধিকাংশ স্থরপথে ভারতে পাচারের জন্য
বিদেশ থেকে বিমান পথে বাংলাদেশে
আসে।
মুদ্রা পাচার
বিদেশে অবৈধভাবে অর্জিত দেশে আনয়নের
জন্য অথবা আয়কর ফাঁকি প্রদানের
উদ্দেশ্যেই দেশাভ্যন্তরে মুদ্রা পাচার করা
হয়। অন্যদিকে বৈদেশিক মুদ্রা দেশের
বাইরে নেয়ার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা
এড়ানোর জন্যও মুদ্রা পাচার করা হয়।
উল্লেখ্য যে বৈধ পথে কিংবা শুল্ক ঘাঁটির
মাধ্যমে ঘোষণা না-দিয়ে মুদ্রা আনয়নের
প্রচেষ্টাকে অবৈধ আমদানীর পরিবর্তে
চোরাচালান হিসেবে গণ্য করা হয়। শুল্ক
আইনে এমত পৃথক প্রবিধান রয়েছে। এ জন্যে
মুদ্রা আনয়নকারীকে বিমান বন্দরে শুল্ক
কর্মকর্তার নিকট লিখিত ছকে ঘোষণা দিতে
হয়।
মানি লণ্ডারিং
দেশে অবৈধভাবে উপার্জ্জিত টাকা বা
কালো টাকা প্রথমে অবৈধ পন্থায় বিদেশে
পাচার করা হয় এবং পরে বিদেশ থেকে বৈধ
পথে ফেরৎ আনা হয়। এ ধরণের কার্যক্রমকে
বলা হয় মানি লণ্ডারিং বা অর্থশোধন।
অনেক ক্ষেত্রে ব্যাংকের সক্রিয় সহায়তায়
অর্থশোধন কার্যক্রম চলে।
মাদকদ্রব্য পাচার
মারিজুয়ানা, এলএসডি, হেরোইন, ইয়াবা
ইত্যাদি মাদকদ্রব্য সর্বাংশে
চোরাচালানের মাধ্যমে এক দেশে থেকে
অন্য দেশে আনা-নেয়া করা হয়ে থাকে।
বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে ভীতিকর হলো
ভারত থেকে ফেনসিডিল নামীয় একটি
ঔষধের চোরাচালান। এটি মূলত ঔষধ জাতীয়
পণ্য হলেও অতিমাত্রায় সেবনে নেশার সৃষ্টি
হয়। ১৯৮০-এর দশক থেকে শুরু করে ক্রমশঃ
ভারত থেকে বাংলাদেশে ফেনসিডিলের
চোরাচালান বৃদ্ধি পেয়েছে। এ জন্যে
ভারতের বিভিন্ন স্থানে বাংলাদেশ-ভারত
সীমান্ত বরাবর ফেনসিডিলের কারখানা
স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া সমুদ্র পথে
হেরোইন বা ব্রাউন শ্যুগারও আনয়ন করা হয়।
মাদ্রক দ্রব্যের তালিকায় নতুন (২০০৪-২০০৯)
সংযুক্ত হয়েছে একটি ঔষধ যার নাম ইয়াবা।
প্রত্নতত্ব পাচার
যে সব পণ্যের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক
চোরাচালানী চক্র সক্রিয় তার মধ্যে অন্যতম
হলো প্রত্নতত্ব। স্বাভাবিক ভাবেই এসব
পণ্যের রপ্তানী আইনতঃ নিষিদ্ধ। তাই
চোরাচালানের মাধ্যমেই এ সব জিনিস
দেশের বাইরে নেয়া হয় এবং উচ্চ মূল্যে
বিক্রি করা হয়। পৃথিবীর বড় বড় জাদুঘরের
সংগ্রহ গড়ে উঠেছে পাচারকৃত প্রত্নতত্ব
সংগ্রহের মাধ্যমে। বাংলাদেশ থেকে
প্রায়শঃ কষ্ঠি পাথরের মূর্তি পাচারের
ঘটনা পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়ে থাকে।
অস্ত্রশস্ত্র
দেশের আভ্যন্তরিক সশস্ত্র সংগ্রাম
পরিচালনার জন্য বা ক্ষেত্র বিশেষে
অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড সংঘটনের জন্য অবৈধ
অস্ত্র-শস্ত্র প্রয়োজন হয়। এ ধরণের অস্ত্র-
শস্ত্র চোরাচালানের মাধ্যমেই সংগৃহীত হয়ে
থাকে। আর এ সবের মূল্য পরিশোধের জন্য
প্রয়োজন হয় মুদ্রা পাচারের। বাংলাদেশের
দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে বিশেষ করে কক্সবাজার
এলাকায় রয়েছে চোরাচালানের মাধ্যমে
আনীত অস্ত্র-শস্ত্রের বাজার। মিয়ানমার
সীমান্ত দিয়ে নিয়মিত অস্ত্র-শস্ত্র এবং
গোলাগুলি পাচারের খবর পত্র-পত্রিকায়
প্রকাশিত হয়। এছাড়া কর্ণফুলি নদীর
মোহনার নিকটবর্তী এলাকা দিয়ে সমুদ্র
পথেও অস্ত্র-শস্ত্রের চোরাচালান সংঘটিত
হয়ে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ
পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রের জন্য অস্ত্র
চোরাচালানের ট্র্যানজিট রুট হিসেবেও
ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
চোরাচালানের অর্থনীতি
চোরাচালানের অর্থনীতির বিষয় প্রধানতঃ
দুটি। প্রথমতঃ চোরাচালান কেন সংঘটিত হয়
তা ব্যাখ্যা করা এবং দ্বিতীয়তঃ
চোরাচালান বা অবৈধ আন্তর্জাতিক
বাণিজ্যের কারণে দেশীয় অর্থনীতিতে যে
প্রতিক্রিয়া হয় তা ব্যাখ্যা করা।
অর্থনীতিবিদগণ চোরাচালানকে একটি
অর্থনৈতিক কার্যক্রম হিসেবে বিবেচনা
করে থাকেন। অন্যদিকে চোরাচালান একটি
দেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান উৎস।
চোরাচালানের শাস্তি
চোরাচালানের শাস্তি দ্বিবিধ। প্রথমতঃ
চোরাচালানের শাস্তি হিসেবে পাচারকৃত
পণ্য রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত হবে।
দ্বিতীয়তঃ চোরাচাোনকারীকে শাস্তি
পেতে হবে। শেষোক্ত শাস্তি দ্বিবিধ। যথাঃ
অর্থদণ্ড বা জরিমানা এবং, দ্বিতীয়তঃ
কারাবাস। শুল্ক আইন ১৯৬৯ এবং বিশেষ
ক্ষমতা আইন ১৯৭৪ উভয় আইনেই
চোরাচালানের শাস্তি বিধৃত আছে। বিশেষ
ক্ষমতা আইন ১৯৭৪ অনুযায়ী চোরাচালান
একটি জামিনঅযোগ্য অপরাধ।
চোরাচালান প্রতিরোধ
সাধারণতঃ স্থলপথের চোরাচালান
প্রতিরোধে সীমান্ত প্রতিরক্ষা বাহিনীকে
দায়িত্ব প্রদান করা হয়। বাংলাদেশের সমুদ্র
সীমানায় তথা জল পথে সংঘটিত
চোরাচালান প্রতিরোধের দায়িত্ব কোস্ট
গার্ড-এর সঙ্গে-সঙ্গে বাংলাদেশ নৌ
বাহিনী-কেও প্রদান করা হয়েছে। তবে স্থল
বন্দর, সমুদ্র বন্দর এবং বিমান বন্দর এবং
সন্নিহিত স্থানে সংঘটিত চোরাচালান
প্রতিরোধের দায়িত্ব শুল্ক বিভাগ বা
কাস্টমস্-এর ওপর অর্পিত আছে। এছাড়া মাদক
দ্রব্যের চোরাচালন প্রতিরোধের জন্যও পৃথক
সংস্থা রয়েছে। বাংলাদেশে চোরাচালন
প্রতিরোধের জন্য নগদ অর্থ পুরস্কারের
প্রবিধান আছে। বাংলাদেশের শুল্ক আইনের
১৮শ অধ্যায়ে চোরাচালান প্রতিরোধের
বিধিবিধান বর্ণিত আছে।