দ্বিতীয় বা বহুবিবাহ
বহুবিবাহ
কালাম মোল্লা ও পারুলের বিয়ে হয়েছে ৫
বছর। তাদের একটি কন্যা সন্তানও আছে।
কালাম রাজমিস্ত্রি হিসেবে বাড়ি থেকে
দূরে বিভিন্ন জায়গায় কাজ করে। গত ১ মাস
ধরে সে দূরে কোথাও কাজ করছিল এবং
কয়েকদিন আগে হঠাৎ আবার একটি বিয়ে
করে নতুন বউ এনে বাড়িতে তুলেছে। পারুল
এর প্রতিবাদ করলে সে বলে ‘সতীনের সাথে
থাকতে না পারলে বাড়ি ছেড়ে চলে যা’। এ
অবস্থায় পারুল পাশের বাড়ির কলেজ পড়ুয়া
মেয়েকে নিয়ে উকিলের কাছে যায়।
পারুল : আমার স্বামী যে আরেকটি বিয়ে
করল এটা কি উচিত হয়েছে ?
উকিল : না, উচিত হয়নি। একজন স্ত্রী থাকতে
আরেকটি বিয়ে বা একাধিক স্ত্রী থাকতে
আবার বিয়ে করাকে বহুবিবাহ বলে। মুসলিম
আইনে বহুবিবাহকে অনুমোদন করা হলেও এর
শর্তাবলী বহুবিবাহকে নিরুৎসাহিতই করেছে।
খ্রিস্টান ধর্মে বহু বিবাহ নিষিদ্ধ। হিন্দু
ধর্মে বহু বিবাহের প্রচলন নেই।
পারুল : আমার স্বামী যে বলল, ইসলাম ধর্মে
৪টি বিয়ে করা যায়েজ আছে সে কথা কি
ঠিক ?
ছবির স্বত্ব : বারসিক
উকিল : ইসলামের আদি যুগে তৎকালীন আর্থ
সামাজিক অবস্থার প্রেক্ষিতে ইসলাম ধর্মে
বহু বিবাহ প্রথা অনুমোদিত হয়েছিল। পবিত্র
কোরআন মজিদে যে আয়াতের দ্বারা এটি
স্বীকৃত হয়েছে তাতে অনুমতির চেয়ে নিষেধ
করার বৈশিষ্ট্যই প্রধান হিসেবে দেখা যায়।
পবিত্র কোরআনের ভাষ্য অনুযায়ী যদি কোন
ব্যক্তি আশংকা করেন যে, সে এতিমদের
প্রতি যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম
হবেন না, সে অবস্থায় সে ভাল মনে করলে
বিধবা নারীকে (এতিমের মা) বিয়ে করতে
পারেন। এভাবে সে এক হতে সর্বোচ্চ চার জন
পর্যন্ত নারীকে বিয়ে করতে পারেন। তবে
যদি সে আশংকা করেন যে, সে স্ত্রীদের
মধ্যে সমান আচরণ করতে পারবেন না;
সেক্ষেত্রে অবশ্যই মাত্র একজন স্ত্র্রী গ্রহণ
করতে পারবেন। ব্যাখ্যা: ১
পারুল : আমার অনুমতি না নিয়ে আমার স্বামী
যে আরেকটি বিয়ে করল এ ব্যাপারে কোন
আইন নেই ?
উকিল : হ্যাঁ আছে, ১৯৬১ সালের মুসলিম
পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ এর ৬ ধারায় বহু
বিবাহের জন্য বর্তমান স্ত্রীর অনুমতি নেয়ার
বাধ্যবাধকতার বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে বলা
হয়েছে। ব্যাখ্যা:২
পারুলের বোন : প্রথম স্ত্রীর অনুমতি ছাড়া
বহু বিবাহ করলে আইনের বিচারে শাস্তি হবে
কি না ?
উকিল : অবশ্যই শাস্তি হবে। এ বিষয়ে আইনে
শাস্তির বিধান আছে। ব্যাখ্যা: ৩
উকিল : বহু বিবাহ করার জন্য চেয়ারম্যানের
কাছে আবেদন করতে হয়। এ ব্যাপারে
চেয়ারম্যানের কিছু দায়িত্ব আছে।
পারুল : কি দায়িত্ব আছে ?
উকিল : প্রথম স্ত্রী আসলেই তার স্বামীকে
বহু বিবাহ করতে অনুমতি দিয়েছে কি না তা
খতিয়ে দেখা চেয়ারম্যানের দায়িত্ব।
ব্যাখ্যা: ৪
পারুল : বর্তমান স্ত্রী অনুমতি দিলেই কি
চেয়ারম্যান স্বামীকে বহু বিবাহের অনুমতি
দিয়ে দিবেন?
উকিল : ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক
আইন অধ্যাদেশ এর ৬ ধারাটি বহু বিবাহের
প্রথার উপর এক ধরণের নিষেধাজ্ঞা আরোপ
করেছে। আর এ কারণেই সালিসী পরিষদের
হস্তক্ষেপের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। বহু
বিবাহের অনুমতির জন্য চেয়ারম্যানের কাছে
আবেদন করা হলে তিনি সালিসী পরিষদ গঠন
করবেন। আবেদনকৃত বহু বিবাহের অনুমতি
দেয়া হবে কি না, তা বিবেচনা করার জন্য
সালিসী পরিষদ যথেষ্টভাবে সুচিন্তিত
ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন। তাই বর্তমান
স্ত্রী অনুমতি দিলেও সালিসী পরিষদ বহু
বিবাহের অনুমতি প্রদানে বাধ্য নয়। ব্যাখ্যা:
৫
পারুরলে বোন : বহু বিবাহ পড়ানোর সময়
কাজীর কোন দায়িত্ব আছে কি ?
উকিল : অবশ্যই কিছু দায়িত্ব আছে। ব্যাখ্যা:
৬
উকিল : বহুবিবাহের ফলে সামাজ নানাভাবে
ক্ষতিগ্রস্থ হয়। যেমন-
বহুবিবাহ পুরুষের একচেটিয়া অধিকার হওয়ার
কারণে আমাদের সমাজে একাধিক বিয়ের
মাধ্যমে নারী নির্যাতন করা হয়।
বহুবিবাহ অবৈধ না হওয়ার কারণে বেশিরভাগ
ক্ষেত্রে স্ত্রী এবং সালিসী পরিষদের
অনুমতি ছাড়াই বহু বিবাহ হয়।
যেক্ষেত্রে সালিসী পরিষদ বহুবিবাহের
অনুমতি দেয় না সেক্ষেত্রে স্ত্রীকে তালাক
দিয়ে বহুবিবাহ সংঘটিত হয়।
বহুবিবাহের কারণে পরিবারে যে অশান্তি
আসে তার মাধ্যমে পরিবারের শিশুরা
ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
পারুল উকিলের মাধ্যমে স্বামীর বিরুদ্ধে
মামলা করে এবং সালিসী পরিষদের বিনা
অনুমতিতে দ্বিতীয় বিয়ে করার অপরাধে
কালাম বর্তমানে শাস্তি ভোগ করছে।
সচরাচর জিজ্ঞাসা
প্রশ্ন-১.বহুবিবাহের শাস্তি কি?
উত্তর: অনুমতি ছাড়া বহুবিবাহ শাস্তিযোগ্য
অপরাধ। এক্ষেত্রে শাস্তি হলো এক বছরের
বর্ধনযোগ্য বিনাশ্রম কারাদন্ড অথবা ১০
হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয়দন্ড।
প্রশ্ন-২. ইসলাম কি বহুবিবাহকে উৎসাহিত
করেছে?
উত্তর: না, ইসলামে বহুবিবাহের যে শর্ত
প্রদান করা হয়েছে তা পালন করা যে কোন
মানুষের পক্ষে অসম্ভব। ফলে এই শর্তের
দ্বারা ইসলাম বহুবিবাহকে নিরুৎসাহিত
করেছে।
প্রশ্ন-৩. বহুবিবাহের সামাজিক ফলাফল
কি?
উত্তর: বহুবিবাহের ফলে পরিবার ও সমাজে
অশান্তি বেড়ে যায়। পরিবারের শিশুরা
ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বহুবিবাহ পুরুষের একচেটিয়া
অধিকার হওয়ার কারণে আমাদের সমাজে
একাধিক বিয়ের মাধ্যমে নারী নির্যাতন
করা হয়। তাই মুসলিম আইনের বহুবিবাহ ধারার
সংশোধন ও যথাযথ বাস্তবায়ন প্রয়োজন।
প্রশ্ন-৪.বহুবিবাহের কারণ কি?
উত্তর.
সন্তানের আকাঙ্খা।
ছেলে সন্তান না থাকা।
যৌতুকের লোভ।
শিক্ষার অভাব।
কুসংস্কার।
নৈতিক অধ:পতন।
উত্তরাধিকার আইনে কন্যার সমান অধিকার
না থাকা।
তথ্যসূত্র
মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ, ১৯৬১।
পারিবারিক আইনে বাংলাদেশের নারী,
পৃষ্ঠা-৪৯, প্রথম প্রকাশ জুন: ১৯৯৭, আইন ও
সালিশ কেন্দ্র।
পারিবারিক আইনে বাংলাদেশের নারী
আইন ও সালিশ কেন্দ্র কর্তৃক নারী-পুরুষ
সাম্যের ভিত্তিতে সামাজিক ন্যায় বিচার
প্রকল্পের প্রকাশনা, জুন-১৯৯৭। (সম্পাদিত)
মুসলিম ও পারিবারিক আইন পরিচিতি,
মোহাম্মদ মজিবর রহমান, পৃষ্ঠা- ২৬৪-২৬৬,
বাদশাহ পাবলিশার্স, ঢাকা, ১৯৮৯
বহুবিবাহ : ব্যাখ্যা
ব্যাখ্যা: ১
‘আর তোমরা যদি আশংকা কর যে
পিতৃহীনদের ওপর সুবিচার করতে পারবে না
তবে বিয়ে করবে (স্বাধীনা) নারীদের মধ্যে,
যাকে তোমাদের ভালো লাগে, দুই, তিন বা
চার। আর যদি আশংকা কর যে সুবিচার করতে
পারবে না তবে একজনকে, বা তোমাদের
অধিকারভূক্ত দাসীকে। এভাবেই তোমাদের
পক্ষপাতিত্ত্ব না করার সম্ভাবনা বেশি। আর
তোমরা নারীদের তাদের দেনমোহর খুশি
মনে দিয়ে দাও, পরে তারা খুশি মনে তার
কিছু ছেড়ে দিলে তোমরা তা স্বাচ্ছন্দে
ভোগ করবে।’¾ ৪ নিসা : ৩-৪ (কোরআনসূত্র)
সুতরাং এটি সুস্পষ্ট যে, একমাত্র এতিমদের
স্বার্থ রক্ষার্থেই একাধিক বিয়ের অনুমতি
ইসলাম প্রদান করেছে। তাছাড়া একাধিক
স্ত্রী বিদ্যমান থাকলে তাদের মধ্যে অবশ্যই
সমান আচরণ ও ব্যবহার প্রদর্শন করতে হবে।
মানুষের স্নেহ ও ভালবাসার পরিমানের উপর
কারো হাত বা নিয়ন্ত্রণ নেই। এটি
লাগামহীন গতিতে ভারসাম্যহীনভাবে
বিশেষ কারো প্রতি প্রবল আকার ধারণ
করতে পারে। আর এ কারণেই কোরআন
মজিদে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা বহু বিবাহকে
নিরুৎসাহিত করেছেন। কুরআন মজিদে যে শর্ত
আরোপ করা হয়েছে তা বহু বিবাহকে নিষেধ
করারই শামিল। (আমীর আলী, দি স্পিরিট অব
ইসলাম, ২২৯)
ব্যাখ্যা: ২
◊ ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন
অধ্যাদেশের ৬ ধারায় বহুবিবাহকে শর্তাধীন
করা হয়েছে। এই আইনে কোন ব্যক্তি যদি এক
স্ত্রীর বর্তমানে আবারো বিয়ে করতে চায়
তাহলে তার এলাকার ইউনিয়ন পরিষদের
চেয়ারম্যানের নিকট বিয়ের অনুমতি চেয়ে
আবেদন করতে হবে। উল্লেখ্য, আবেদনপত্রের
সাথে প্রথম স্ত্রীর অনুমতি রয়েছে এই মর্মে
অনুমতি পত্র থাকতে হবে।
চেয়ারম্যান আবেদন পাওয়ার পর স্ত্রীর
পক্ষের একজন ও স্বামী পক্ষের একজন
প্রতিনিধি নিয়ে সালিসী পরিষদ গঠন
করবেন।
সালিসী পরিষদ স্ত্রীর অনুমতি পর্যালোচনা
করে এবং স্বামীর বিয়ে করার ন্যায়সঙ্গত
কারণ থাকলে পুনরায় লিখিত বিয়ের অনুমতি
পত্র দিবেন। বিশেষভাবে মনে রাখতে হবে,
দ্বিতীয় বিয়ের অনুমতি স্ত্রী নয়, সালিসী
পরিষদের অনুমতিই আইন সঙ্গত অনুমতি পত্র।
ব্যাখ্যা: ৩
◊ কেউ যদি সালিসী পরিষদের অনুমতি
ছাড়া বিয়ে করেন তাহলে ১৯৭৪ সালের
মুসলিম বিবাহ ও তালাক রেজিস্ট্রেশন
আইনের অধীনে বিয়ে রেজিস্ট্রি করা যাবে
না।
সালিসী পরিষদের অনুমতি ছাড়া বিয়ে
করলে বর্তমান স্ত্রী বা স্ত্রীদের সম্পূর্ণ
দেনমোহর তাৎক্ষণিকভাবে পরিশোধ করতে
হবে।
স্ত্রী ও সালিসী পরিষদের অনুমতি ছাড়া
বিয়ের অভিযোগ আদালতে প্রমাণিত হলে
একবছর কারাদন্ড বা ১০ হাজার টাকা
জরিমানা বা উভয়দন্ড হতে পারে।
অনুমতি বিহীন দ্বিতীয় বা পুনরায় বিয়ে
শাস্তিযোগ্য অপরাধ কিন্তু বিয়ে অবৈধ নয়।
দ্বিতীয় বিয়ের কারণে প্রথম স্ত্রী আদালতে
স্বামীর বিরুদ্ধে বিয়ে বিচ্ছেদ চাইতে
পারেন।
ব্যাখ্যা: ৪
◊ কোন ব্যক্তি দ্বিতীয় বা পুনরায় বিয়ে
করার আবেদন করার পর চেয়ারম্যান দেখবেন
স্ত্রী স্ব-ইচ্ছায় অনুমতি দিয়েছেন কিনা।
চেয়ারম্যান ও সালিসী পরিষদ সন্তুষ্ট না
হলে দ্বিতীয় বা পুনরায় বিবাহের অনুমতি
নাও দিতে পারেন।
ব্যাখ্যা: ৫
বহু বিবাহের অনুমতির জন্য আবেদন করা হলে
সালিসী পরিষদ বর্তমান স্ত্রীর অনুমতি সহ
অন্যান্য যে সকল পরিস্থিতির প্রতি লক্ষ্য
রাখবেন, সেগুলো হলো:
বর্তমান স্ত্রীর বন্ধ্যাত্ব
দৈহিক দূর্বলতা
দাম্পত্য সম্পর্কের জন্য দৈহিক অনুপযুক্ততা
দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধারের জন্য প্রদত্ত
আদালতের কোন ডিক্রিকে ইচ্ছাকৃতভাবে
এড়ানো
বর্তমান স্ত্রীর মানসিক অসুস্থতা ইত্যাদি
কিন্তু এ সকল বিষয় বা অন্যান্য কারণসমূহ
বিদ্যমান থাকলে সালিসী পরিষদ বহু
বিবাহের পক্ষে সিদ্ধান্ত দিতে বাধ্য নয়।
পরিষদ নিজস্ব পন্থায় এ গুলির প্রেক্ষাপট ও
কারণ বিশ্লেষণ করে তাদের সিদ্ধান্ত
প্রদান করতে পারে।
ব্যাখ্যা: ৬
বিবাহ রেজিস্ট্রিকালীন সময়ে কাজীর
দায়িত্ব হচ্ছে বিয়েটি বহু বিবাহ কিনা তার
খোঁজ নেয়া।
বহুবিবাহ হলে শালিসী পরিষদের লিখিত
অনুমতিপত্র আছে কিনা তা যাচাই করা।
দ্বিতীয় বা বহুবিবাহ বহুবিবাহ আইন
10 Sunday May 2015
Posted LAW
in