image

অধ্যাপক মেজর (অব.) মো. আশরাফুল
ইসলাম :: সাইনোসাইটিসের
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সাইনাসের স্থানীয়
উপসর্গ ছাড়াও সাধারণত রোগীদের যে
লক্ষণগুলো দেখা যায় সেগুলো হচ্ছে :
সাইনাসগুলোর অবস্থানের ওপর কিংবা
আশপাশে ব্যথা ও শরীর ম্যাজম্যাজ করা,
কোনো কাজে মনোনিবেশ করতে না পারা,
দুশ্চিন্তা, জ্বর জ্বর ভাব, নাক থেকে পুঁজ বা
পুঁজজাতীয় পদার্থ নির্গত হওয়া ইত্যাদি। এ
ছাড়া যখন কোনো নিশ্চিত কাঠামোকে
যেমন ব্রেইন বা ব্রেইনের ঝিল্লি, চোখ বা
কান ইত্যাদি আক্রান্ত করে, তখন নির্দিষ্ট ঐ
কাঠামোর উপসর্গগুলো মূলত কঠিনভাবে
দেখা দেয়। এ সমন্ধে বিস্তারিত আলোচনা
পরে করা হবে।
এই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার উপসর্গ জানার আগে
প্রথমেই জানা দরকার সাইনোসাইটিস
রোগের প্রধান ও সাধারণ উপসর্গগুলো কি
কি। আর এগুলো জানা থাকলে
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার যে সমস্ত উপসর্গ হয়ে
থাকে, সেগুলো বোঝা সহজ হবে বলে আশা
করা যায়।
সাইনোসাইটিস রোগের সাধারণ ও প্রধান
উপসর্গ :
ব্যথা : সাইনোসাইটিসের ব্যথা কোন
সাইনাস আক্রান্ত হয়েছে মূলত তার ওপর
অনেকাংশ নির্ভর করে। উদাহরণস্বরূপ বলা
যেতে পারে ম্যাক্সিলারি সাইনাসের ব্যথা
ও ম্যাক্সিলারি সাইনাসের অবস্থানের ওপর
অর্থাৎ নাকের পাশে, গাল, দাঁত কিংবা মুখ
বা মুখম-লের আশপাশে হয়ে থাকে। ফ্রন্টাল
সাইনাসের ব্যথা সাধারণত কপালে, চোখে,
চোখের পেছনে কিংবা মাথায় অনুভূত হয়।
অনেক সময় এই ধরনের মাথা ব্যথার সঙ্গে
সঙ্গে মাথার মধ্যে হালকা শূন্যতা বা হালকা
হালকা অনুভূতি জাগে। যার জন্য এ ধরনের
মাথা ব্যথাকে অনেকে ‘ভ্যাকুয়াম ফ্রন্টাল
হেডেক’ বলে থাকেন। আর এই ফ্রন্টালহেডেক
বা ফ্রন্টাল মাথা ব্যথা প্রায়শ ঘুম থেকে
জাগার পর আরম্ভ হয়। আর দিন যতো বাড়তে
থাকে, মাথা ব্যথাও সেই সঙ্গে বাড়তে
থাকে আবার বিকালের দিকে মাথা ব্যথার
তীব্রতা আবার কমতে কমতে আপনা আপনি
ভালো হয়ে যায়। ইথময়ডাল সাইনাসের ব্যথা
দুচোখের মাঝে ও চোখের পেছনে সাধারণত
হয়ে থাকে। এই ব্যথা মুখ ও মুখম-লে অনেকে
অনুভব করেন। স্ফেনোইডাল সাইনোসাইটিসের
ব্যথা কিন্তু মাথার মাঝখানে হয়। আর এই
ব্যথা অনেক সময় দিকে বা চোখের পেছনে
রেডিয়েট করতে পারে।
নাক বন্ধ : সাইনাস যখন প্রদাহে আক্রান্ত হয়
তখন তার নিঃসৃত পুঁজজাতীয় প্রদাহ নাকের
মধ্যে এসে নাকের ও প্রদাহের সৃষ্টি করে
এবং তা ফুলে অনেক সময় নাক বন্ধের কারণ
হয়ে দেখা দিতে পারে। কিন্তু আসলে
সাইনোসাইটিসের কারণ হিসেবে যদি
নাকের ও সাইনাসের স্বাভাবিক
কার্যক্ষমতার জন্য নাকের মধ্যে কোনো
বাধা যেমনÑ ডিএনএস বা নাকের মাংস বড়
হয়ে (টারবিনেট বড় হয়ে) থাকে সেগুলোর
জন্য হতে পারে। সুতরাং এই সমস্ত কারণ
উদঘাটন সাইনোসাইটিস রোগের মুখ্য উদ্দেশ্য
হয়ে থাকে। আর তাই এই কারণগুলো চিকিৎসা
করলে সাইনোসাইটিস ভালো হয়ে যায়।
নাক থেকে পুঁজ বা নিঃসৃত পদার্থ :
সাইনোসাইটিসের প্রদাহজনিত কারণে নাক
থেকে পুঁজ বা পুঁজজাতীয় বেরুতে থাকে
আবার যেহেতু ম্যাক্সিলারি সাইনাসকে অন্য
সাইনাসগুলোর মাস্টার বলা হয়ে থাকে, তাই
এই সাইনাসের আক্রমণ সহসাই হয়ে থাকে।
আর ম্যাক্সিলারি সাইনাসের পুঁজ দুর্গন্ধও
বটে।
এই সমস্ত উপসর্গ ছাড়াও শিশু-কিশোরদের
সাইনোসাইটিস রোগের উপসর্গ কিছু
বাড়তিভাবে দেখা যায়। বিশেষ করে এ
সময়ে তাদের চোখ ও চোখের পাতা ফোলা-
ফোলা থাকে, সময় সময় নাক বন্ধ, মুখ হাঁ করে
ঘুমানো, মুখ ও নাক থেকে দুর্গন্ধ বের হওয়া,
নাকডাকা, অত্যধিক লালা পড়া যা কিনা
বালিশ বা বিছানা ভিজিয়ে রাখে, ঘন ঘন
কাশি, আবার কোনো সময় বমি করাও তাদের
অভ্যাসে পরিণত হয়।
এই স্বাভাবিক উপসর্গগুলো খতিয়ে দেখে এর
চিকিৎসা করলে এই রোগের কবল থেকে
যেমন মুক্তি পাওয়া যায়, তেমনি এর
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থেকেও মুক্তি পাওয়া
সম্ভব। তাহলে এবার দেখা যাক এর
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কি কি হতে পারে। এই
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ওপর ভিত্তি করেই তার
উপসর্গগুলো চিহ্নিত করা হয়।
সাইনোসাইটিস রোগের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
: সাইনোসাইটিসের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াকে
নিম্নলিখিতভাবে ভাগ করা যায়। যেমনÑ
ব্রেইন ও ব্রেইনের খুলির বাইরে ব্রেইন ও
ব্রেইনের ঝিল্লি বা আবরণের ও
সাইনোসাইটিস রোগের পর্যায়ক্রমিক
আবির্ভাব।
যেহেতু সাইনাসগুলো কাঠামোগত দিক থেকে
ব্রেইন, ব্রেইনের আবরণ এবং চোখের অতি
সন্নিকেটে, তা অতিসহজেই সাইনাসের
প্রদাহ ওই সমস্ত জায়গাকে আক্রান্ত করতে
পারে। আর এ সমস্ত জায়গাকে আক্রান্ত
করলে রোগীর অবস্থা মারাত্মক হয়, এমনকি
জীবনহানির আশঙ্কাও থাকে। তাই এ
সম্পর্কে সজাগ থাকা দরকার।
ব্রেইনের বা ঝিল্লির বাইরে : ফ্রন্টাল বা
ম্যাক্সিলারি বোনের ক্রনিক প্রদাহ বা
অস্টিওমাইলাইটিস যদিও ফ্রন্টাল বোনকে
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আক্রমণ করে।
চোখের জটিলতা : যেমন অরবিটাল
সেলুলাইটিস, চোখের পাতায় সেলুলাইটিস,
চোখের মধ্যে অ্যবসেস ইত্যাদি। মুখ ও মুখম-ল
ফুলে যাওয়া
খুলির ভেতরে জটিলতা : ব্রেইনের ঝিল্লির
প্রদাহ, ব্রেইন প্রদাহ, ব্রেইনের ভেতরে
শিরা-উপশিরার রক্ত প্রবাহে বাধাদান
করে।
সাইনোসাইটিসের পর্যায়ক্রমিক প্রভাব :
যেমন ফ্যারিংস, টনসিল, কানের কণ্ঠনালী,
ব্রংকাসের প্রদাহ কিংবা
ব্রংকেয়াক্টেসিসের সঙ্গে থাকতে পারে।
এমনকি সাইনোসাইটিস অ্যাজমার কারণেও
হতে পারে। অনেক সময় শরীরের কোথাও
প্রদাহ হলে তা যদি সাধারণ চিকিৎসায়
প্রশমিত না হয়, তবে এই সাইনাসের কথা স্মরণ
করে তার রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা করা
দরকার। এই জন্য অনেক সময়
সাইনোসাইটিসকে ঋড়পঁং ড়ভ ওহভবপঃরড়হ
বলা হয়ে থাকে। সুতরাং সাইনোসাইটিসের
রোগ অবহেলা না করে এই রোগের প্রাথমিক
অবস্থায় চিকিৎসা করলে এর মারাত্মক
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কিংবা ভোগান্তি
থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব।
ডিএনএস ও সাইনোসাইটিস থেকে ফুসফুস
কেন আক্রান্ত হয় :
সাইনোসাইটিস বা নাকের প্রদাহজনিত
রোগের সঙ্গে ব্রঙ্কেয়েক্টেসিস নামক এক
রকম চেষ্ট ডিজিজের সুসম্পর্ক কুইন এবং
মেয়ার নামক দুজন চিকিৎসা বিজ্ঞানী ১৯২৯
সালে লিপিবদ্ধ করেছেন। শুধু তাই নয়, ঐ
বিজ্ঞানীরা নাকের সব ধরনের প্রদাহের
সঙ্গে ক্রনিক এবং বারবার বা রিকারেন্ট
ব্রঙ্কাইটিসের কারণও উল্লেখ করেছেন।
কোনো নামের আরেকজন চিকিৎসা
বিজ্ঞানী ১৯৮১ সালে ২০০ রোগীর এক
সমীক্ষায় ফুসফুসে পুঁজজাতীয় পদার্থ তৈরি
এবং মুখ-নাক দিয়ে নির্গত হওয়ার কারণ
হিসেবে সাইনোসাইটিস রোগকে দায়ী
করেছেন এবং সমীক্ষায় শতকরা ৪২ জন ফুসফুস
সংক্রান্ত রোগী বা ব্রঙ্কেয়েক্টসিস
সাইনোসাইটিস রোগ থেকে উৎপন্ন হয়েছে
বলে প্রমাণ করেছেন। শ্বাসনালীর ওপরের
এবং নিচের অংশের প্রতিরোধের
কার্যপ্রণালী কিংবা প্রতিরোধের ক্রিয়া
প্রায় একইভাবে হয়ে থাকে। এই প্রতিরোধ
যে জিনিসটি করে তার নাম সিলিয়া বা
ঝিল্লি। কার্যত এই সিলিয়া বা ঝিল্লি
ঝাড়–র কাজ করে থাকে। কোনো অযাচিত
বস্তু নাকের মধ্যে ঢুকে গেলে এই
ঝিল্লিগুলো তা বের করবে বা ধ্বংস করার
জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। উল্লেখ করা দরকার,
এই ঝিল্লি বা সিলিয়া নাকের মধ্যে বা
আশপাশের জায়গাগুলো যেমনÑ মাইনাস,
টারবিনেট থেকে ফুসফুস পর্যন্ত বিস্তৃত।
সুতরাং নাকে যদি কোনো রোগে এই
ঝিল্লির ক্ষতিসাধন করে তবে তার প্রভাব
ফুসফুসের ওপর গিয়ে পড়ে এবং ফুসফুসের রোগ
দেখা দেয়। কাঠামোগত নাককে এভাবে ভাগ
করা যেতে পারে। যেমনÑ নাকের ক্যাডিটি,
নাকের মধ্যকার পার্টিশন, টারবিনেট,
মাইনাস ইত্যাদি। এ সমস্ত কাঠামোর ওপরের
আবরণের কোষে অনেকগুলো সিলিয়া বা
ঝিল্লি থাকে। যেহেতু নাকের
কাঠামোগুলো একই পরিসরে অবস্থান করে
এবং একে অপরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে
সংযুক্ত তাই নাকের ভেতরের কোনো এক
জায়গা প্রদাহ বা অন্য কোনো রোগ হলে সেই
রোগ সঙ্গে সঙ্গে আশপাশের জায়গাকেও
আক্রান্ত করতে পারে। আর এই রোগ তখন
কালক্রমে শ্বাসনালীর নিচের অংশকে
আক্রান্ত করে ফুসফুস পর্যন্ত যায় এবং
ফুসফুসের সূক্ষ্ম শৈল্পিক কারুকার্য নষ্ট করে
বিভিন্ন রোগের সৃষ্টি করে। আর অনেকে
মনে করেন, নাকের অনেক রোগ চেস্ট
ডিজিজ বা বক্ষব্যাধির প্রতিবিম্ব। যার
জন্য বক্ষব্যাধি রোগ বা চেস্ট ডিজিজ
প্রায়শ নাকের রোগের সঙ্গে দেখা দেয়
এবং এসব ধরনের রোগী সাধারণত নাক, কান,
গলা ও বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ প্রায় ক্ষেত্রে
রোগের কারণ গতানুগতিক, রোগের বিস্তার
পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং রোগের চিকিৎসা
পদ্ধতি মোটামুটি একই করে থাকেন। নাকের
ভেতরে এবং আশপাশে প্রদাহজনিত কারণে
যে রোগ হয় তাকে রাইনাইটিস এবং
সাইনোসাইটিস বলে। বর্তমানে এই দুই
অবস্থাকে রাইনো সাইনোসাইটিস বলে।
আবার এই রাইনো সাইনোসাইটিসসহ ফুসফুসের
সূক্ষ্ম অবকাঠামোকে ধ্বংস করার মূল হোতা।
রাইনো সাইনোসাইটিস রোগের কারণ :
১. নাকের ভেতরে যদি নাকের পার্টিশন
বাঁকা থাকে (যাকে ডিএনএস বলে), নাক
ভাঙা বা নাকের আঘাত টিনমার কিংবা
নাকের ভেতরে যদি কোনো অযাচিত বস্তু
ঢোকে।
২. অ্যালার্জিজনিত কারণ।
৩. নাকের ভেতরে যে ঝিল্লি থাকে তার
কার্যক্ষমতা লোপ পেলে।
৪. দাঁতের রোগ বা দাঁত সাইনাসের মধ্যে
ঢুকে গেলে।
৫. যক্ষ্মা, সিফিলিস, কুষ্ঠ বা অন্যান্য
গ্রানুলোমেটাস রোগের কারণে।
৬. হরমোন সংক্রান্ত জটিলতার কারণে।
ফাংগাস দ্বারা আক্রান্ত হলে এই রোগের
উপসর্গ কি কি হতে পারে :
ক. নাক বন্ধ থাকা- এক নাক বন্ধ কিংবা দুই
নাক একত্রে হতে পারে।
খ. নাক থেকে পানি বা পুঁজজাতীয় পদার্থ
নির্গত হওয়া।
গ. নাক থেকে রক্ত বা রক্তজাতীয় পদার্থ
যাওয়া।
ঘ. নাকে গন্ধ না পাওয়া বা নাক দিয়ে
দুর্গন্ধ বের হওয়া।
ঙ. মাথা ব্যথা।
চ. নাকের পেছনে ময়লা জমা বা খুকখুকে
কাশি।
ছ. নাকে কথা বলে ইত্যাদি।
উপরোক্ত উপসর্গ দেখা দিলে অবশ্যই
কালবিলম্ব না করে একজন নাক, কান, গলা
বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেয়া উচিত। আর সমস্ত
রোগের চিকিৎসা প্রথমাবস্থায় করলে অনেক
দুরারোগ্য বা কঠিন বক্ষব্যাধি থেকে
পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব।
অধ্যাপক মেজর (অব.) মো. আশরাফুল ইসলাম
নাক, কান ও গলা বিশেষজ্ঞ ও বিভাগীয়
প্রধান
ই এন টি-হেড ও নেক সার্জারি বিভাগ
বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ এন্ড
হাসপাতাল।
তথ্যসূত্র : হেলদিলাইফ টুয়েন্টিফোর ডট কম