ভিটামিন বি কমপ্লেক্স এর কাজ, উৎস এবং অভাবজনিত রোগ
‘বি’ কমপ্লেক্স বলতে বোঝানো হয় ভিটামিন ‘বি’ গোত্রের ৮ টি দ্রবণীয় বি ভিটামিনের যৌগ যা একসাথে শক্তির উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে। তারা খাদ্যকে এনার্জিতে রূপান্তরিত হতে সাহায্য করে। দেহের অত্যাবশ্যকীয় উপাদানগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ভিটামিন বি। মানবদেহের অত্যন্ত জরুরী কিছু ফাংশন নিয়ন্ত্রণে এটি সাহায্য করে। শরীরকে চাঙ্গা রাখতে ভিটামিন বি-এর জুড়ি মেলা ভার। সারা দিনে শরীরের ভেতরে যে ক্ষতের সৃষ্টি হয়, তার চিকিৎসা মূলত এই ভিটামিনটিই করে থাকে। সেইসঙ্গে আরও নানাবিধ গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্ব রয়েছে ভিটামিন বি-এর উপর। তাই প্রতিদিনই আমাদের শরীরে ভিটামিন বি কমপ্লেক্স এর প্রয়োজন রয়েছে।
মানসম্মত ডায়েট চার্ট, স্বাস্থ্য টিপস এবং পুষ্টিকর খাবারের রেসিপির ভিডিও দেখতে পুষ্টিবাড়ির ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করে রাখুন… ইউটিউব চ্যানেলটিতে প্রবেশ করতে এখানে ক্লিক করুন।
ভিটামিন বি কমপ্লেক্সের ৮ টি ভিটামিন হচ্ছে- থায়ামিন(বি১), রিবোফ্লাবিন(বি২), নায়াসিন(বি৩), পেন্টোথেনিক এসিড(বি৫), পাইরিডক্সিন(বি৬), বায়োটিন(বি৭), ফোলেট(বি৯) এবং কোবালামিন(বি১২)। এগুলোকে একসঙ্গে ভিটামিন ‘বি’ কমপ্লেক্স বলা হয়।
ভিটামিন বি-কমপ্লেক্স
গুরুত্ব এবং উৎস
ভিটামিন বি-কমপ্লেক্স গোষ্ঠীর কাজ হলো বিশেষ বিশেষ উৎসেচকের অংশ হিসেবে আমিষ, শর্করা ও স্নহ পদার্থকে বিশিষ্ট করা এবং এদের অন্তর্নিহিত শক্তিকে মুক্ত হতে সাহায্য করা।
ভিটামিন বি১ (থায়ামিন)
বি১ ভিটামিনটিকে থায়ামিন নামেও ডাকা হয়। এর প্রধান কাজ হলো শর্করা বিপাকে অংশগ্রহণ করে শক্তিমুক্ত করা। তাছাড়া স্বাভাবিক ক্ষুধা বজায় রাখতে এবং স্নায়ুতন্ত্রকে সক্রিয় রাখতে সহায়তা করা। সেইসঙ্গে কোষেদের কর্মক্ষমতা বাড়াতেও বিশেষ ভূমিকা নেয় বি১। প্রসঙ্গত, ডাল এবং হোল গ্রেন খাবারে এই ভিটামনটি প্রচুর পরিমাণে থাকে।
ভিটামিন বি২ (রিবোফ্লাবিন)
এটা অ্যামাইনো এসিড, ফ্যাটি এসিড ও কার্বহাইড্রেডের বিপাকে অংশ নিয়ে শক্তি উৎপাদনে সাহায্য করা। হজম ক্ষমতার উন্নতি ঘটানোর পাশাপাশি গ্যাস-অম্বলের প্রকোপ কমাতে এবং ব্লাড সেলের সংখ্যা বৃদ্ধিতেও সাহায্য করে বি২। বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, চুল এবং ত্বকের সৌন্দর্য বৃদ্ধিতেও এই বি২ বিশেষ কাজে আসে। তাইতো প্রতিদিন বি২ ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবার, যেমন- বিনস, দুধ, দই এবং ডিম খাওয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসকেরা।
ভিটামিন বি৩
হার্ট অ্যাটাকের কারণে যদি মরতে না চান, তাহলে বি৩ এর ঘাটতি যাতে কোন সময় না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখুন। কারণ বি৩ শরীরে উপস্থিত বাজে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমানোর পাশাপাশি ভাসকুলার ডিজঅর্ডার এবং শ্বাসকষ্টজনিত নানাবিধ সমস্যাকে দূর রাখতে বিশেষ ভূমিকা নেয়। সেইসঙ্গে হাড়কে শক্তপোক্ত করতেও সাহায্য করে। সাধারণত সামুদ্রিক মাছ, মাংস এবং বাদামে ভিটামিন বি৩ পাওয়া যায়।
ভিটামিন বি৫
নিয়মিত ডিম, বাদাম, দুগ্ধজাত খাবার, ব্রকলি, হোল গ্রেন এবং বিনস খেলে শরীরে এই ভিটামিনটির ঘাটতি দূর হয়। বি৫ কোষের গঠনেও বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
ভিটামিন বি৬ (পাইরিডক্সিন)
এটা শক্তি উৎপাদনে সহায়তা করে। প্রায় ১০০ ধরনের এনজাইম রিঅ্যাকশন যাতে ঠিক মতো হয়, সেদিকে খেয়াল রাখে ভিটামিন বি৬। সেইসঙ্গে প্রোটিন মেটাবলিজম প্রক্রিয়াও ত্বরান্বিত করে। প্রসঙ্গত, দুধ, দই, ডিম, মাংস এবং সবুজ শাক-সবজিতে এই ভিটামিনটি প্রচুর পরিমাণে থাকে।
ভিটামিন বি৭
চুলের সৌন্দর্য বাড়ানোর পাশাপাশি ত্বক এবং নখকে সুন্দর রাখার দায়িত্ব রয়েছে বি৭ এর উপর। শুধু তাই নয়, মেটাবলিজম প্রক্রিয়া যাতে ঠিক মতো হয়, সেদিকেও খেয়াল রাখে ভিটামিন বি৭। মাংস, সয়াবিন এবং পনিরে এই ভিটামিন পাওয়া যায়।
ভিটামিন বি৯
প্রেগন্যান্সির সময় বি৯ ভিটামিনটির প্রয়োজন বেড়ে যায়। কারণ চিকিৎসক মহলে ফলেট নামে পরিচিত এই পুষ্টিকর উপাদানটি, শরীর যাতে ঠিক মতো প্রোটিন গ্রহণ করতে পারে, সেদিকে নজর রাখে। সেই সঙ্গে গর্ভাবস্থায় যাতে কোন ধরনের জটিলতা প্রকাশ না পায়, সে ব্যাপারেও সাহায্য করে। সেই কারণেই তো ভাবি মায়েদের নিয়মিত সবুজ শাক-সবজি, হোল গ্রেন খাবার, বিনস, ডাল এবং কলা খাওয়ার পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা।
ভিটামিন বি১২ (সায়ানোকোবালামিন)
এটা লোহিত রক্তকণিকা বৃদ্ধি ও উৎপাদনে সহায়তা করে। শ্বেত রক্তকণিকা ও অনুচক্রিকার সংখ্যা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।সেইসঙ্গে ব্রেন ফাংশনে যাতে কোন ব্যাঘাত না ঘটে সেদিকেও নজর রাখে। এই ভিটামিনটির খোঁজ মেলে মূলত দুগ্ধজাত খাবার, ডিম, মাংস, সামুদ্রিক মাছ এবং সবজিতে।
ভিটামিন বি কমপ্লেক্স এর কিছু অভাবজনিত রোগঃ
ভিটামিন বি ১ – এর অভাবে বেরিবেরি রোগ হয়। দূর্বলতা, বুক ধড়ফড় করা, হাত পা ব্যাথা করা ইত্যাদি এই ভিটামিন বি ১ এর অভাবে হয়ে থাকে।
ভিটামিন বি ২ – ঠোঁট এবং তালু ফাটা, ঠোঁটের কোনায় ঘা, গলা শুকিয়ে যাওয়া ইত্যাদি এই ভিটামিন বি ২ এর অভাবে হয়ে থাকে।
ভিটামিন বি ৩ – চুলকানি, ত্বক খসখসে হয়ে যাওয়া, দূর্বলতা এবং ডাইরিয়া বি ৩ এর অভাবে হয়ে থাকে।
ভিটামিন বি ৫ – এর অভাবে ত্বকের সমস্যা দেখা দিতে পারে।
ভিটামিন বি ৬ – উচ্চ রক্তচাপ,রক্ত স্বল্পতা,বিষন্নতা এবং ত্বকের সমস্যা ভিটামিন বি ৬ এর অভাবে অভাবে হয়ে থাকে।
ভিটামিন বি ৭ – শিশুদের বৃদ্ধি এবং মানসিক বৃদ্ধি ভিটামিন বি ৭ এর অভাবে ব্যাহত হয়।
ভিটামিন বি ৯ – অভাবে রক্ত স্বল্পতা হয়। গর্ভবতি মায়েদের ভিটামিন বি ৯ এর অভাবে গর্ভস্থ শিশুর জন্মবিকৃতি ঘটে থাকে।
ভিটামিন বি ১২ – এর অভাবে রক্তস্বল্পতা এবং মানসিক সমস্যা দেখা যায়
আরোও বিস্তারিত
ভিটামিনের অভাব বোঝার ৬ লক্ষণ
সারাদিন যে পরিমাণে পরিশ্রম হচ্ছে সে পরিমাণে খাবার না খাওয়ায় শরীরে পর্যাপ্ত ভিটামিনের চাহিদা পূরণ হচ্ছে না। যার কারণে শারীরিকভাবে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। এছাড়া শরীরের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতাও কমে যায়।
শরীরে ভিটামিনের অভাব হলে শারীরিকভাবে কিছু অস্বাভাবিক লক্ষণ দেখা যায়। শরীরে ভিটামিনের অভাব বোঝার ৬ লক্ষণ দেওয়া হলো-
১) অতিরিক্ত চুল পড়া ও পেকে যাওয়া
অতিরিক্ত চুল পড়া ও তাড়াতাড়ি চুল পেকে যাওয়ার কারণ হচ্ছে যত্নের অভাব বা কসমেটিকের জন্য, এটি অনেকেই মনে করেন। কিন্তু এই ধারণাটি ভুল, এটি কোনো ধরণের কেমিক্যালের প্রভাব নয় বা যত্নের অভাব নয়। এটি ভিটামিন বি৭ (বায়োটিন), ভিটামিন এ, ডি, ই এবং কে এর অভাবজনিত সমস্যার লক্ষণ।
এই ভিটামিনের অভাব পূরণ করার উপায় : মাছ, ডিম, মাশরুম, ফুলকপি, বাদাম, তিলের বীজ ও কলা রাখুন প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায়।
২) হাতে ও পায়ে ঝি ঝি ধরা
হাতে ও পায়ে ঝি ঝি ধরা, পায়ের পাতা, তালু এবং পায়ের পেছনের অংশে ব্যথা অনুভব করার সমস্যায় পড়েন কমবেশি অনেকেই। আমরা ধরেই নেই এ সকল সমস্যার কারণ একটানা বসে থাকা ও নার্ভে চাপ পড়া। কিন্তু এই সমস্যাগুলোর মূলে রয়েছে ওয়াটার স্যলুবল বি ভিটামিন, ম্যাগনেসিয়াম, ক্যালসিয়াম ও পটাশিয়ামের অভাব।
ভিটামিনের অভাব পূরণ : সবুজ শাক, কাঠবাদাম, তাল, কমলা, কলা, চিনাবাদাম, ডাবের পানি, কিশমিশ, কাজু বাদাম ইত্যাদি রাখুন খাদ্য তালিকায়।
৩) ঠোঁটের কিনার ও পায়ের গোড়ালি ফেটে যাওয়া
ঠোঁটের কিনার ফাটা ও পায়ের গোড়ালি ফেটে যাওয়ার কারণ হচ্ছে ভিটামিনের অভাব। আমরা অনেকেই মনে করি, ঠোঁট ফাটা বা ঠোঁটের কিনার ফাটা শীতকালের সমস্যা অথবা একটু পানিশূন্যতার লক্ষণ। কিন্তু এটি ভিটামিন বি৩, বি২ ও বি১২ এবং আয়রন, জিংক ও দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গঠনকারী গুরুত্বপূর্ণ প্রোটিনের অভাবের লক্ষণ।
ভিটামিনের অভাব পূরণ : ডিম, টমেটো, চিনাবাদাম, ডাল, দই, পনির, ঘি এবং ভিটামিন সি জাতীয় খাবার রাখুন খাদ্য তালিকায়।
৪) দেহের নানা অংশ অবশ হয়ে যাওয়া
দেহের নানা অংশে অবশবোধ হওয়া খুবই সাধারণ একটি লক্ষণ। অনেক সময় আমরা ভাবি একটানা একভাবে বসে থাকা কিংবা নার্ভের ওপর চাপ পড়ার কারণে এটি ঘটে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে ভিটামিন বি৯, বি৬ এবং বি১২ এর অভাব দেহে হলে এই লক্ষণটি দেখা দেয়। এছাড়াও ভিটামিনের অভাবের কারণে বিষণ্ণতা, রক্তস্বল্পতা, দুর্বলতা এবং হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার মতো লক্ষণও দেখা যায়।
ভিটামিনের অভাব পূরণ : সামুদ্রিক মাছ, লাল চালের ভাত, বাদাম, ডিম, মুরগির মাংস, কলা, ব্রকলি, ফুলকপি, বাঁধাকপি এবং সবুজ শাক রাখুন খাদ্য তালিকায়।
৫) পেশিতে টান ধরা
মাঝে মাঝে পায়ের হাঁটুর পিছনের পেশিতে টান ধরলে বুঝতে হবে, ভিটামিন বি ও তার সঙ্গে ক্যালশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম ও পটাশিয়ামের কমতি রয়েছে শরীরে।
অভাব পূরণ : ছোট মুরগীর মাংস বেশি করে খেতে হবে তার সঙ্গে ডিম ও দুধ রাখা প্রয়োজন।
৬) দেহের বিভিন্ন অংশে লাল ও সাদা রংয়ের ফোস্কা ওঠা
মুখ, বাহু, উরু এবং দেহের পিঠের নিচে ও পেছনের অংশে লাল বা সাদাটে রংয়ের ফোস্কা উঠে, সেটা আমরা সাধারণ সমস্যা মনে করি। কিন্তু আসলে দেহের এই সকল স্থানে লালচে ও সাদাটে রংয়ের ফোস্কা ভিটামিন এ ও ডি এবং এসেনশিয়াল ফ্যাটি এসিডের অভাবের লক্ষণ।
ভিটামিনের অভাব পূরণ : একটানা অনেকক্ষণ এসি ঘরে থাকবেন না, সূর্যের আলোতে বের হন, প্রচুর পরিমাণে মাছ, শাকসবজি ও ডিম রাখুন খাদ্য তালিকায়।